মোক্ষদা একাদশী তিথি তথা গীতা জয়ন্তী মহোৎসব, তাই সকলকে জানাই শুভ মোক্ষদা একাদশী তিথির ও গীতা জয়ন্তী মহোৎসবের
কৃষ্ণ প্রীতি শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন
গীতা জয়ন্তী
এই তিথিতেই পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা বীর অর্জুনকে ৫১৫১ (৩১৩৯ খ্রীঃপূঃনভেম্বর ০২ তারিখ শুক্রবার) বছর আগে কুরুক্ষেত্র (৬০ কিঃমিঃ) নামক স্থানে ভগবদ্গীতার জ্ঞান দান করেছিলেন । তাই এই মহিমা মণ্ডিত তিথিকে গীতা জয়ন্তী তিথি বলা হয় ।
গীতা সর্ম্পকে কিছু বহিরঙ্গা জ্ঞান
১। গীতা হচ্ছে সমস্ত শাস্ত্রের
সারতিসার এমনকি গীতায় এমন কিছু
আছে যা অন্যান্য কোন শাস্ত্রে
পাওয়া যায় না । যেমন – ৫ম পুরুষার্থ
২। মহাভারতের ভীষ্মপর্বের ২৫
থেকে ৪২ নং অধ্যায়ের এই ১৮ টি
অধ্যায় হল ভগবদগীতা বা
গীতোপনিষদ ।
৩। গীতায় আছে ৭০০ শ্লোক (কেউ
বলে ৭৪৫ শ্লোক) আছে । তার মধ্যে
ধৃতরাষ্ট্র বলেন ১টি শ্লোক, সঞ্জয়
বলেন ৪০টি শ্লোক, অর্জুন বলেন
৮৫টি শ্লোক, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন
৫৭৪টি শ্লোক । আর পুরো গীতায়
৯৫৮০ টি সংস্কৃত শব্দ আছে ।
৪। গীতার ১৮টি অধ্যায়ের মধ্যে
প্রথম ৬টি অধ্যায়কে বলে কর্মষটক,
মাঝখানের ৬টি অধ্যায়কে বলে
ভক্তিষটক, আর বাকি ৬টি অধ্যায়কে
বলে জ্ঞানষটক ।
৫। গীতা পড়লে ৫টি জিনিষ
সর্ম্পকে জানা যায় – ঈশ্বর, জীব,
প্রকৃতি, কাল ও কর্ম ।
৬। যদিও গীতার জ্ঞান ৫০০০ বছর
আগে বলেছিল কিন্তু ভগবান চতুর্থ
অধ্যায় বলেছেন এই জ্ঞান তিনি এর
আগেও বলেছেন, মহাভারতের
শান্তিপর্বে (৩৪৮/৫২-৫২) গীতার
ইতিহাস উল্লেখ আছে । তার মানে
গীতা প্রথমে বলা হয় ১২,০৪,০০,০০০
বছর আগে, মানব সমাজে এই জ্ঞান
প্রায় ২০,০০,০০০ বছর ধরে বর্তমান,
কিন্তু কালের বিবর্তনে তা
হারিয়ে গেলে পুনরায় আবার তা
অর্জুনকে দেন ।
৭। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে মাত্র ৪০
মিনিটে এই গীতার জ্ঞান দেন ।
৮। গীতার মাহাত্ম্য অনেকে করে
গেছেন তার মধ্যে শ্রীশঙ্করাচার্য,
স্কন্দপুরাণ থেকে শ্রীল ব্যাসদেব,
শ্রীবৈষ্ণবীয় তন্ত্রসারে গীতা
মাহাত্ম্য আর আছে পদ্মপুরাণে
দেবাদিদেব শিব কর্তৃক ১৮টি
অধ্যায়ের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন
।
৯। গীতাতে অর্জুনের ২০টি নাম আর
কৃষ্ণের ৩৩টি নামের উল্লেখ করা
হয়েছে ।
১০। গীতাতে মাং এবং মামেব
কথাটি বেশি আছে, যোগ শব্দটি
আছে ৭৮ বার, যোগী আছে ২৮ বার
আর যুক্ত আছে ৪৯ বার ।
১১। গীতার ২য় অধ্যায়কে বলা হয়
গীতার সারাংশ ।
১২। ভগবান যখন বিশ্বরূপ দেখান তখন
কাল থেমে যায় ।
১৩। ভগবান শুধু যুদ্ধের আগেই গীতা
বলেনি ১৮ দিন যুদ্ধের মাঝখানেও
গীতা বলেছে ।
১৪। গীতায় অর্জুন ১৬টি প্রশ্ন করে আর
কৃষ্ণ তার উত্তর দেন, কৃষ্ণ তা ৫৭৪টি
শ্লোকের মাধ্যমে উত্তর দেন ।
১৫। পুরো গীতার সারমর্ম মাত্র ৪টি
শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে, ১০
অধ্যায়ের ৮ থেকে ১১ নং শ্লোক ।
১৬। পুরো গীতায় অর্জুন ৪৫ নামে
কৃষ্ণকে সম্বধোন করছেন, আর কৃষ্ণ
অর্জুনকে ২১টি নামে সম্বধোন
করেছেন ।
১৭। গীতার ৫ম অধ্যায় ১৩ থেকে ১৬
নং শ্লোকে তিনজন কর্তার কথা
বলা হয়েছে ।
১৮। গীতায় ৩টি গুণ, ৩টি দুঃখ আর
৪টি আমাদের প্রধান সমস্যার কথা
বলেছে ।
১৯। ত্রিশ্লোকী গীতার জ্ঞান ঃ
যা বেদ ও বেদান্তের সার, ১৫
অধ্যায়ের ১৬ থেকে ১৮ নং শ্লোক ।
২০। গীতায় ২৬টি গুণের কথা বলা
হয়েছে আর ৬টি আসুরিক প্রবৃত্তির
কথা বলা হয়েছে।
২১। নরকের ৩টি দ্বারের কথা বলা
হয়েছে (কাম, ক্রোধ ও লোভ)
২২। গীতার ১৮ অধ্যায় ব্রাক্ষ্মনের
৯টি গুণ, ক্ষত্রিয়ের ৭টি গুণ, বৈশ্যের
৩টি গুণ আর শুদ্রের ১টি গুণ ।
২৩। ৩টি কর্মের প্রেরণা আর ৩টি
কর্মের আশ্রয়ের কথা বলা আছে ।
২৪। বেদান্ত শাস্ত্রের সিধান্ত
অনুসারে কর্মসমূহের সিদ্ধির
উদ্দেশ্যে ৫টি নির্দিষ্ট কারণ কথা
বলা হয়েছে ।
২৫। গুণ অনুসারে ৩ প্রকারের
ত্যাগের কথা বলা হয়েছে ।
২৬। ৩ প্রকারের আহার, যজ্ঞ, তপস্যা,
শ্রদ্ধা, পূজা ও দানের কথা বলা
হয়েছে ।
২৭। ২টি স্বভাবের জীবের কথা বলা
হয়েছে ।
২৮। ২ প্রকার জীবের কথা বলা
হয়েছে ।
২৯। ১৮টি আত্মজ্ঞানের সাধনার
গুনের কথা বলা হয়েছে ।
৩০। ব্রক্ষ্ম উপলব্ধির ৫টি স্তরের কথা
বলা হয়েছে ।
৩১। ভক্তদের ৩৬ টি গুণের কথা বলা
হয়েছে ।
৩২। গীতায় ২৫ জন সৃষ্টের কথা বলা
হয়েছে যারা স্থাবর, জঙ্গম ও সমস্ত
প্রজাদের সৃষ্টি করেছেন ।
৩৩। গীতায় নারীর ৭টি গুণের কথা
বলা হয়েছে ।
৩৪। ৪ প্রকার সুকৃতিবান ব্যক্তির কথা
বলা হয়েছে । আর ৪ প্রকার
দুষ্কৃতিবানের কথা
বলা হয়েছে ।
৩৫। জড়া প্রকৃতির ৮টি উপাদানের
কথা বলা হয়েছে ।
আত্মার চিন্ময় তত্ত্ব, ভগবৎ-তত্ত্ব এবং ভগবান ও আত্মার সম্পর্ক -এই সব অপ্রাকৃত তত্ত্বজ্ঞান বিশুদ্ধ ও মুক্তিপ্রদায়ী। এই প্রকার জ্ঞান হচ্ছে নিঃস্বার্থ ভক্তিমূলক কর্মের (কর্মযোগ) ফলস্বরূপ। পরমেশ্বর ভগবান গীতার সুদীর্ঘ ইতিহাস, জড় জগতে যুগে যুগে তার অবতরণের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য এবং আত্মজ্ঞানলব্ধ গুরুর সান্নিধ্য লাভের আবশ্যকতা ব্যাখ্যা করেছেন।
বহিঃবিচারে সকল কর্তব্যকর্ম সাধন করলেও সেগুলির কর্মফল পরিত্যাগ করার মাধ্যমে, জ্ঞানবান ব্যক্তি পারমার্থিক জ্ঞানতত্ত্বের অগ্নিস্পর্শে পরিশুদ্ধি লাভ করে থাকেন, ফলে শান্তি, নিরাসক্তি, চিন্ময় অন্তর্দৃষ্টি এবং শুদ্ধ আনন্দ লাভ করেন।
নিয়মতান্ত্রিক ধ্যানচর্চার মাধ্যমে অষ্টাঙ্গযোগ অনুশীলন মন ও ইন্দ্রিয় আদি দমন করে এবং অন্তর্যামী পরমাত্মার চিন্তায় মনকে নিবিষ্ট রাখে।এই অনুশীলনের পরিণামে পরমেশ্বরের পূর্ণ ভাবনারূপ সমাধি অর্জিত হয়।
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমতত্ত্ব, সর্বকারণের পরম কারণ এবং জড় ও চিন্ময় সর্ববিষয়ের প্রাণশক্তি। উন্নত জীবাত্মাগণ ভক্তি ভরে তার কাছে আত্মসমর্পণ করে থাকেন, পক্ষান্তরে অধার্মিক জীবাত্মারা অন্যান্য বিষয়ের ভজনায় তাদের মন বিক্ষিপ্ত করে থাকে।
অক্ষরব্রহ্ম-যোগ
আজীবন কৃষ্ণের চিন্তার মাধ্যমে এবং বিশেষ করে মৃত্যুকালে তাকে স্মরণ করে, মানুষ জড় জগতের ঊর্ধ্বে ভগবানের পরম ধাম লাভ করতে পারে।
রাজবিদ্যা-রাজগুহ্য যোগ
কৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং পরমারাধ্য বিষয়। অপ্রাকৃত ভগবত-সেবার মাধ্যমে জীবাত্মা মাত্রই তার সাথে নিত্য সম্বন্ধযুক্ত। মানুষের শুদ্ধ ভক্তি পুনরুজ্জীবিত করার ফলে শ্রীকৃষ্ণের পরম ধামে প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব।জড় জগতের বা চিন্ময় জগতের শৌর্য, শ্রী, আড়ম্বর, উতকরশ-সমস্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় কৃষ্ণের দিব্য শক্তি ও পরম ঐশ্বর্যাবলির আংশিক প্রকাশ মাত্র অভিব্যক্ত হয়ে আছে। সর্বকারণের পরম কারণ, সর্ববিষয়ের আশ্রয় ও সারাতিসার রূপে কৃষ্ণ সর্বজীবেরই পরমারাধ্য বিষয়।
চিম্নয় জগতের সর্বোত্তম প্রাপ্তি বিশুদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম লাভের পক্ষে ভক্তিযোগ বা কৃষ্ণের উদ্দেশ্য শুদ্ধ ভক্তি হচ্ছে সর্বোত্তম পন্থা। যারা এই পরম পন্থার বিকাশ সাধনে নিয়োজিত থাকেন, তারা দিব্য গুণাবলীর অধিকারী হন।
দেহ, আত্মা এবং উভয়েরও ঊর্ধ্বে পরমাত্মার পার্থক্য যিনি উপলব্ধি করতে পারেন, তিনিই এই জড় জগৎ থেকে মুক্তি লাভে সক্ষম হন।
সমস্ত দেহধারী জীবাত্মা মাত্রই সত্ত্ব, রজ ও তম—জড়া প্রকৃতির এই ত্রিগুণের নিয়ন্ত্রণাধীন। পরমেশ্বর কৃষ্ণ এই ত্রিগুণাবলির স্বরূপ, আমাদের ওপর সেগুলির ক্রিয়াকলাপ, মানুষ কিভাবে সেগুলিকে অতিক্রম করে এবং যে মানুষ অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত তার লক্ষণাবলী ব্যাখ্যা করেছেন।
বৈদিক জ্ঞানের চরম উদ্দেশ্য হচ্ছে জড়-জাগতিক বন্ধন থেকে মানুষের মুক্তি লাভ এবং পরম পুরুষোত্তম ভগবানরূপে কৃষ্ণকে উপলব্ধি করা। যে মানুষ কৃষ্ণের পরম স্বরূপ উপলব্ধি করে, সে তার কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং ভক্তিমূলক সেবায় আত্মনিয়োগ করে।
যারা আসুরিক গুণগুলি অর্জন করে এবং শাস্ত্রবিধি অনুসরণ না করে যথেচ্ছভাবে জীবন যাপন করে থাকে, তারা হীনজন্ম ও ক্রমশ জাগতিক বন্ধনদশা লাভ করে। কিন্তু যারা দিব্য গুণাবলির অধিকারী এবং শাস্ত্রীয় অনুশাসনাদি মেনে বিধিবদ্ধ জীবন যাপন করেন, তারা ক্রমান্বয়ে পারমার্থিক সিদ্ধিলাভ করেন।
জড় প্রকৃতির ত্রিগুণাবলির থেকে উদ্ভূত এবং সেগুলির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শ্রদ্ধা তিন ধরনের হয়ে থাকে। যাদের শ্রদ্ধা রাজসিক ও তামসিক, তারা নিতান্তই অনিত্য জড়-জাগতিক ফল উৎপন্ন করে। পক্ষান্তরে, শাস্ত্রীয় অনুশাসন আদি মতে অনুষ্ঠিত সত্ত্বগুণময় কার্যাবলি হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করে এবং পরিণামে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শুদ্ধ ভক্তি-শ্রদ্ধার পথে মানুষকে পরিচালিত করে ভক্তিভাব জাগ্রত করে তোলে।
- Home
- মঙ্গলাচরণ
- শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অধ্যায় ভিত্তিক সারসংক্ষেপ
- প্রথম অধ্যায়- অর্জুন বিষাদ-যোগ
- দ্বিতীয় অধ্যায়- সাংখ্য-যোগ
- তৃতীয় অধ্যায়- কর্মযোগ
- চতুর্থ অধ্যায়- জ্ঞানযোগ
- পঞ্চম অধ্যায়-কর্মসন্ন্যাস-যোগ
- ষষ্ঠ অধ্যায়-ধ্যানযোগ
- সপ্তম অধ্যায়-বিজ্ঞান-যোগ
- অষ্টম অধ্যায়-অক্ষরব্রহ্ম-যোগ
- নবম অধ্যায়-রাজগুহ্য-যোগ
- দশম অধ্যায়-বিভূতি-যোগ
- একাদশ-অধ্যায়-বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
- দ্বাদশ-অধ্যায়-ভক্তিযোগ
- প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
- চতুর্দশ-অধ্যায়-গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
- পঞ্চদশ-অধ্যায়-পুরুষোত্তম-যোগ
- ষোড়শ-অধ্যায়-দৈবাসুর-সম্পদ-বিভাগযোগ
- সপ্তদশ-অধ্যায়-শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
- অষ্টাদশ অধ্যায়-মোক্ষযোগ
- গীতা-মাহাত্ম্য
- সনাতন জ্ঞান ভান্ডারের হোম পেইজে ফিরে যান
|
|
একসময় জৈমিনি ঋষি তার গুরুদেব মহর্ষি ব্যাসদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে গুরুদেব! একাদশী কী? একাদশীতে কেন উপবাস করতে হয়? একাদশী ব্রত করলে কী লাভ? একাদশী ব্রত না করলে কী ক্ষতি? এ সব বিষয়ে আপনি দয়া করে বলুন।
মহর্ষি ব্যাসদেব তখন বলতে লাগলেন-সৃষ্টির প্রারম্ভে পরমেশ্বর ভগবান এই জড় সংসারে স্থাবর জঙ্গম সৃষ্টি...করলেন।
মর্ত্যলোকবাসী মানুষদের শাসনের জন্য একটি পাপপুরুষ নির্মাণ করলেনা। সেই পাপপুরুষের অঙ্গণ্ডলো বিভিন্ন পাপ দিয়ে নির্মিত হল। পাপপুরুষের মাথাটি ব্রহ্মহত্যা পাপ দিয়ে, চক্ষুদুটি মদ্যপান, মুখ স্বর্ণ অপহরণ, দুই কর্ণ-ণ্ডরুপত্নী গমন, দুই নাসিকা-স্ত্রীহত্যা, দুই বাছ-গোহত্যা পাপ, গ্রীবা-ধন অপহরণ, গলদেশ-ভ্রূণহত্যা, বক্ষ-পরস্ত্রী-গমন, উদর-আত্মীয়স্বজন বধ, নাভি-শরণাগত বধ, কোমর-আত্মশ্লাঘা, দুই ঊরু-ণ্ডরুনিন্দা, শিশ্ন-কন্যা বিক্রি, মলদ্বার-ণ্ডপ্তকথা প্রকাশ পাপ, দুই পা-পিতৃহত্যা, শরীরের রোম-সমস্ত উপপাতক। এভাবে বিভিন্ন সমস্ত পাপ দ্বারা ভয়ঙ্কর পাপপুরুষ নির্মিত হল।
পাপপুরুষের ভয়ঙ্কর রূপ দর্শন করে ভগবান শ্রীবিষ্ণু মর্ত্যের মানব জাতির দুঃখ মোচন করবার কথা চিন্তা করতে লাগলেন। একদিন গকড়ের পিঠে চড়ে ভগবান চললেন যমরাজের, মন্দিরে। ভগবানকে যমরাজ উপযুক্ত স্বর্ণসিংহাসনে বসিয়ে পাদ্য -অর্ঘ্য ইত্যাদি দিয়ে যথাবিধি তার পূজা করলেন।
যমরাজের সঙ্গে কথোপকথনকালে ভগবান শুনতে পেলেন দক্ষিণ দিক থেকে অসংখ্য জীবের আর্তক্রন্দন ধ্বনি। প্রশ্ন করলেন-এ আর্তক্রন্দন কেন?
যমরাজ বললেন, হে প্রভু, মর্ত্যের পাপী মানুষেরা নিজ কর্মদোষে নরকযন্ত্রণা ভোগ করছে। সেই যাতনার আর্ত চিৎকার শোনা যাচ্ছে।
যন্ত্রণাকাতর পাপাচারী জীবদের দর্শন করে করুণাময় ভগবান চিন্তা করলেন--আমিই সমস্ত প্রজা সৃষ্টি করেছি, আমার সামনেই ওরা কর্ম দোষে দুষ্ট হয়ে নরক যান্ত্রণা ভোগ করছে, এখন আমিই এদের সদগতির ব্যবস্থা করব।
ভগবান শ্রীহরি সেই পাপাচারীদের সামনে একাদশী তিথি রূপে এক দেবীমূর্তিতে প্রকাশিত হলেন। সেই পাপীদেরকে একাদশী ব্রত আচরণ করালেন। একাদশী ব্রতের ফলে তারা সর্বপাপ মুক্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ বৈকুণ্ঠ ধামে গমন করল।
শ্রীব্যাসদেব বললেন, হে জৈমিনি! শ্রীহরির প্রকাশ এই একাদশী সমস্ত সুকর্মের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং সমস্ত ব্রতের মধ্যে উত্তম ব্রত।
কিছুদিন পরে ভগবানের সৃষ্ট পাপপুরুষ এসে শ্রীহরির কাছে করজোড়ে কাতর প্রার্থনা জানাতে লাগল-হে ভগবান! আমি আপনার প্রজা। আমাকে যারা আশ্রয় করে থাকে, তাদের কর্ম অনুযায়ী তাদের দুঃখ দান করাই আমার কাজ ছিল। কিন্তু সম্প্রতি একাদশীর প্রভাবে আমি কিছুই করতে পারছি না, বরং ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছি। কেননা একাদশী ব্রতের ফলে প্রায় সব পাপাচারীরা বৈকুণ্ঠের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছে। হে ভগবান, এখন আমার কী হবে? আমি কাকে আশ্রয় করে থাকব? সবাই যদি বৈকুণ্ঠে চলে যায়, তবে এই মর্ত্য জগতের কী হবে? আপনি বা কার সঙ্গে এই মর্ত্যে ক্রীড়া করবেন?
পাপপুরুষ প্রার্থনা করতে লাগল-হে ভগবান, যদি আপনার এই সৃষ্ট বিশ্বে ক্রীড়া করবার ইচ্ছা থাকে তবে, আমার দুঃখ দূর করুন। একাদশী ভয় থেকে আমাকে রক্ষা করুন। হে কৈটভনাশন, আমি একমাত্র একাদশীর ভয়ে ভীত হয়ে পলায়ন করছি। মানুষ, পশুপাখি, কীট-পতঙ্গ, জলত-স্থল, বনপ্রান্তর, পর্বত-সমুদ্র, বৃক্ষ, নদী, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল সর্বত্রই আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্ত একাদশীর প্রভাবে কোথাও নির্ভয় স্থান পাচ্ছি না দেখে আজ আপনার শরণাপন্ন হয়েছি।
হে ভগবান, এখন দেখছি, আপনার সৃষ্ট অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে একাদশীই প্রাধান্য লাভ করেছে, সেইজন্য আমি কোথাও আশ্রয় পেতে পারছি না। আপনি কৃপা করে আমাকে একটি নির্ভয় স্থান প্রদান করুন।
পাপপুরুষের প্রার্থনা শুনে ভগবান শ্রীহরি বলতে লাগলেন-হে -পাপপুরুষ! তুমি দুঃখ করো না। যখন একাদশী এই ত্রিভুবনকে পবিত্র করতে আবির্ভূত হবে, তখন তুমি অন্ন ও রবিশস্যের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করবে তা হলে আমার মূর্তি একাদশী তোমাকে বধ করতে পারবে না।
একাদশী পালনের নিয়মাবলি
একাদশীর মূল কাজ হল– নিরন্তর ভগবানকে স্মরণ করা। তাই আপনারা যে নিয়মে, যে সময়ে পালন করুন না কেন, ভগবানকে ভক্তিভরে স্মরণ করাই যেন আপনারই মূল কাজ হয়। একাদশী পালনের সাত্ত্বিক নিয়মগুলো হলো:
□ ১। সমর্থ পক্ষে দশমীতে একাহার, একাদশীতে নিরাহার, ও দ্বাদশীতে একাহার করতে হবে ।
□ ২। তা হতে অসমর্থ পক্ষে শুধুমাত্র একাদশীতে অনাহার।
□ ৩। যদি উহাতেও অসমর্থ হন, একাদশীতে পঞ্চ রবিশস্য বর্জন করে ফলমূলাদি অনুকল্প গ্রহণের বিধান রয়েছে।
□ সমর্থ পক্ষে রাত জাগরণের বিধি আছে, গৌড়ীয় ধারায বা আচার্যবৃন্দের অনুমোদিত পঞ্জিকায় যে সমস্ত একাদশী নির্জলা (জল ব্যতীত) পালনের নির্দেশ প্রদান করেছেন, সেগুলি সেমতে পালন করলে সর্বোত্তম হয়। নিরন্তর কৃষ্ণভাবনায় থেকে নিরাহার থাকতে অপারগ হলে নির্জলাসহ অন্যান্য একাদশীতে কিছু — সবজি, ফলমূলাদি গ্রহণ করা যেতে পারে । যেমন — গোল আলু, মিষ্টি আলু, চাল কুমড়ো, পেঁপে, টমেটো, ফুলকপি ইত্যাদি সবজি ঘি অথবা বাদাম তেল দিয়ে রান্না করে ভগবানকে উৎসর্গ করে আহার করতে পারেন। হলুদ, মরিচ, ও লবণ ব্যবহার্য। আবার অন্যান্য আহার্য, যেমন — দুধ, কলা, আপেল, আঙুর, আনারস, আখ, আমড়া শস্য, তরমুজ, বেল, নারিকেল, মিষ্টি আলু , বাদাম ও লেবুর শরবত ইত্যাদি ফলমূলাদিও খাওয়া যেতে পারে ।
□ একাদশীতে পাঁচ প্রকার রবিশস্য গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছেঃ—
□ ১। ধানজাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন – চাউল, মুড়ি, চিড়া, সুজি, পায়েস, খিচুড়ি, চালের পিঠা, খৈ ইত্যাদি
□ ২। গমজাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন – আটা, ময়দা, সুজি, বেকারির রুটি , বা সকল প্রকার বিস্কুট, হরলিকস ইত্যাদি ।
□ ৩। যব বা ভুট্টাজাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন — ছাতু, খই, রুটি ইত্যাদি ।
□ ৪। ডালজাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন — মুগ, মাসকলাই, খেসারি, মসুরি, ছোলা অড়হর, ফেলন, মটরশুঁটি, বরবটি ও সিম ইত্যাদি ।
□ ৫। সরিষার তেল, সয়াবিন তেল, তিলের তেল ইত্যাদি। উপর্যুক্ত পঞ্চ রবিশস্যের যেকোন একটি একাদশীতে গ্রহণ করলে ব্রত নষ্ট হয়।
□ উল্লেখ্য যারা সাত্ত্বিক আহারী নন এবং চা, বিড়ি/সিগারেট, পান, কফি ইত্যাদি নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করেন, একাদশী ব্রত পালনের সময়কাল পর্যন্ত এগুলি গ্রহণ না করাই ভালো।
□ সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, একাদশী করলে যে কেবল নিজের জীবনের সদ্গতি হবে তা নয়। একাদশী পালন করা ব্যক্তির প্রয়াত পিতা/মাতা যদি নিজ কর্ম দোষে নরকবাসী হন, তবে সেই পুত্রই (একাদশী ব্রত) পিতা–মাতাকে নরক থেকে উদ্ধার করতে পারে। একাদশীতে অন্ন ভোজন করলে যেমন নরকবাসী হবে, অন্যকে ভোজন করালেও নরকবাসী হবে।
□ একাদশী পারণঃ (একাদশী তিথির পরদিন উপবাস ব্রত ভাঙার পর নিয়ম) পঞ্জিকাতে একাদশী পারণের (উপবাসের পরদিন সকালে) যে নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে, সেই সময়ের মধ্যে পঞ্চ রবিশস্য ভগবানকে নিবেদন করে, প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করা একান্ত দরকার। নতুবা একাদশীর কোন ফল লাভ হবে না। একাদশী ব্রত পালনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কেবল উপবাস করা নয়, নিরন্তর শ্রীভগবানের নাম স্মরণ, মনন, ও শ্রবণ কীর্তনের মাধ্যমে একাদশীর দিন অতিবাহিত করতে হয় । এদিন যতটুকু সম্ভব উচিত । একাদশী পালনের পরনিন্দা, পরচর্চা, মিথ্যা ভাষণ, ক্রোধ, দুরাচার, স্ত্রী সহবাস সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ। □ বিঃ দ্রঃ নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি রাখা বাঞ্ছনীয়ঃ — একাদশী ব্রতের আগের দিন রাত ১২ টার আগেই অন্ন ভোজন সম্পন্ন করে নিলে সর্বোত্তম। ঘুমানোর আগে দাঁত মাজা।
□ রাতে ব্রাশ করে দাঁত ও মুখগহবরে লেগে থাকা সব অন্ন পরিষ্কার করে নেওয়া সর্বোত্তম। সকালে উঠে শুধু মুখ কুলি ও স্নান করতে হয়।
□ একাদশীতে সবজি কাটার সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন কোথাও কেটে না যায়। একাদশীতে রক্তক্ষরণ বর্জনীয়। দাঁত মাজার সময় অনেকের রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। তাই একাদশীর আগের দিন রাতে দাঁত ভালোভাবে মেজে নেওয়াই সমীচীন।
□ একাদশীতে চলমান একাদশীর মাহাত্ম্য ভগবদ্ভক্তের শ্রীমুখ হতে শ্রবণ অথবা সম্ভব না হলে নিজেই ভক্তি সহকারে পাঠ করতে হয়।
□ যারা একাদশীতে একাদশীর প্রসাদ রান্না করেন, তাদের পাঁচফোড়ন ব্যবহারে সতর্ক থাকা উচিৎ, কারণ পাঁচফোড়নে সরিষার তৈল ও তিল থাকতে পারে যা বর্জনীয়।
□ একাদশীতে শরীরে প্রসাধনী ব্যবহার নিষিদ্ধ। তৈল (শরীরে ও মাথায়) সুগন্ধি, সাবান, শ্যাম্পু ইত্যাদি বর্জনীয়।
□ সকল প্রকার ক্ষৌরকর্ম — দাড়ি-গোঁফ করা এবং চুল ও নখ কাটা নিষিদ্ধ।
যেকোন একাদশির মাহাত্ম্য সম্পর্কে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন- |
- যোগিনী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- শয়ন একাদশী মাহাত্ম্য
- কামিকা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- পবিত্রারোপণী একাদশী মাহাত্ম্য
- অন্নদা একাদশী মাহাত্ম্য
- পার্শ্ব একাদশীর মাহাত্ম্য
- ইন্দিরা একাদশী মাহাত্ম্য
- পাশাঙ্কুশা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- রমা একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য
- উত্থান একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- উৎপন্না একাদশী মাহাত্ম্য
- মোক্ষদা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- সফলা একাদশী মাহাত্ম্য
- পুত্রদা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- ষটতিলা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- পান্ডবা (নির্জলা) একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য .
- বিজয়া একাদশী মাহাত্ম্য
- আমলকী একাদশী মাহাত্ম্য
- পাপমোচনী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- কামদা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- বরুথিনী একাদশী মাহাত্ম্য
- মোহিনী একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য
- অপরা একাদশী ব্রতমাহাত্ম্য
- পদ্মিনী একাদশী মাহাত্ম্য
- সনাতন জ্ঞান ভান্ডারের হোম পেইজে ফিরে যান
আমাদের সমস্ত দুঃখের কারণ অজ্ঞনতা। সুতরাং জানতে হলে পড়তে হবে।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পড়তে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন.......
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার আলোকে মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বজিজ্ঞাসা প্রশ্ন-উত্তরে জানতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন.......
একাদশী ব্রত পালনের তাৎপর্য ও নিয়মাবলি এবং বছরের সব একাদশির মাহাত্ম্য সম্পর্কে জানতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন.......
পূজা-পার্বনের তাৎপর্য ও মহিমা সম্পর্কে জানতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন.......
আরতি-উপসনা-প্রার্থনা সম্পর্কে জানতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন.......
সনাতন পারমার্থিক জ্ঞান সম্পর্কে জানতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন.......
গুরুতত্ত্ব সম্পর্কে জানতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন.......
মধুর নামকীর্তন শুনতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন.......
0 মন্তব্যসমূহ