Paush Makar Sankranti Katha 2022 Gangasagar Mela Snan Time


প্রশ্নঃ সংক্রান্তি বলতে কি বুঝায় এবং সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মকর সংক্রান্তি অনুষ্ঠান কেন পালন করেন? সংক্রান্তি অর্থ সঞ্চার বা গমন করা। সূর্যাদির এক রাশি হতে অন্য রাশিতে সঞ্চার বা গমন করাকেও সংক্রান্তি বলা যায়। সংক্রান্তি শব্দটি বিশ্লেষণ করলেও একই অর্থ পাওয়া যায়; সং+ক্রান্তি, সং অর্থ সঙ সাজা এবং ক্রান্তি অর্থ সংক্রমণ। অর্থাৎ ভিন্ন রূপে সেজে অন্যত্র সংক্রমিত হওয়া বা নুতন সাজে, নুতন রূপে অন্যত্র সঞ্চার হওয়া বা গমন করাকে বুঝায়। বাস্তবেও তা-ই দেখা যায়। মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ এবং মীনÑএই বারটি একটির পর আরেকটি চক্রাকারে অবর্তিত হতে থাকে। রাশিচক্রস্থ দৃশ্যমান গমন পথ যাকে ইংরেজীতে ঊপষরঢ়ঃরপ বা ক্লান্তিবৃত্ত বলে; সেপথে সূর্য গমনের ফলে (জ্যোতিষতত্ত্বমতে) পৃথিবীর পরিমণ্ডলে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। এভাবে পৃথিবী নানারূপে সঞ্চারের কারণে প্রাকৃতিক দৃশ্যপট প্রতিমাসে পরিবর্তিত হতে থাকে। পৃথিবীর পরিমণ্ডলে এধরনের পরিবর্তনের মধ্যে সনাতন ধর্মের অনুসারীগণের মধ্যে চারটি দিন উল্লেখযোগ্য। তন্মমধ্যে দুই অয়ন এবং দুই বিষুব দিন। দুই অয়ন হল উত্তরায়ন ও দক্ষিণায়ন এবং বিষুব হল মহাবিষুব ও জলবিষুব। চৈত্র সংক্রান্তিতে মহাবিষুব ও আশ্বিন সংক্রান্তিতে জলবিষুব আরম্ভ হয়। উল্লেখ্য বছরে যে দুইদিন দিবা ও রাত্রি সমান হয় তাকে বিষুব দিন বলা হয়। বসন্তকালে যে বিষুব হয়, তাকে মহাবিষুব আর শরৎকালে যে বিষুব হয় তাকে জলবিষুব বলা হয়। মৎস্যপুরাণেও তাই বলা হয়েছে- “মৃগকর্কটসংক্রান্তিঃ দ্বে তূদগ্দক্ষিণায়নে। বিষুবতী তুলামেষে গোলমধ্যে তথাপরাঃ ॥” অর্থাৎ সুর্য ধনুরাশি ত্যাগ করে মকর রাশিতে সঞ্চার হওয়াকে উত্তরায়ণসংক্রান্তি, মিথুনরাশি হতে কর্কটরাশিতে সঞ্চার হওয়াকে দক্ষিণায়ন সংক্রান্তি, কন্যারাশি হতে তুলারাশিতে সঞ্চার হওয়াকে জলবিষুবসংক্রান্তি আর মীনরাশি হতে মেষরাশিতে সঞ্চার হওয়াকে মহাবিষুব সংক্রান্তি বলা হয়ে থাকে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, দুই অয়নে এক বছর হয়। সনাতন শাস্ত্রবিদগণের মতে পরমাণু হল অত্যন্ত সূক্ষ্ম কাল অর্থাৎ সর্বশেষ কালের একক। এভাবে দুটি পরমাণুতে হয় এক অনু ও তিন অনুতে একটি ত্রসরেণু হয়। জানালার ফাঁকে আসা সূর্যের কিরণে ত্রসরেণু উড়তে দেখা যায়। এরূপ তিনটি ত্রসরেণু অতিক্রম করতে সূর্যের যে সময় নেয়, তাকে ত্র“টি বলে। এরকম একশত ত্র“টিতে একটি লব, তিন লবে এক নিমেষ, তিন নিমেষে এক ক্ষণ (১.৬ সেকেন্ড) হয়। পাঁচ ক্ষণে এক কাষ্ঠা (৮ সেকেন্ড), পনের কাষ্ঠাতে এক লঘু (২ মিনিট), পনের লঘুতে এক নাড়ি (৩০ মিনিট), ছয় নাড়িতে এক প্রহর (৩ ঘন্টা) আর অষ্টপ্রহরে এক দিনরাত (৩ঢ৮=২৪ ঘন্টা) হয়। পনের দিন-রাতে এক পক্ষ, দুই পক্ষে এক মাস, ছয় মাসে এক অয়ন আর দুই অয়নে এক বছর হয়। মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় এই ছয় মাস উত্তরায়ন কাল এবং শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ ও পৌষ এই ছয় মাস দক্ষিণায়ন কাল। সেজন্য আষাঢ়ের সংক্রান্তিতে দক্ষিণায়ন এবং পৌষ সংক্রান্তিতে উত্তরায়ণ শুরু হয়। অয়ন ভেদে সুর্যেরও দিক পরিবর্তন হয়। উত্তরায়ণে সুর্যের সঞ্চার হওয়া মাত্র সূর্য দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে এবং দক্ষিণায়ণে পুনরায় সূর্য দক্ষিণ দিকে সঞ্চার হতে আরম্ভ করে। পৌষ মাসের শেষ দিনে সূর্য উত্তরায়ণের দিকে যাত্রা শুরু করে বলে এই সংক্রান্তিকে উত্তরায়ণ সংক্রান্তিও বলা হয়। শাস্ত্রমতে মানুষের এক বছর দেবতাদের একটি দিন-রাতের সমান অর্থাৎ মানুষের উত্তরায়ণের ছয়মাস দেবতাদের একটি দিন ও দক্ষিণায়নের ছয়মাস দেবতাদের একটি রাত। রাত্রে মানুষ যেমন সকল দরজা-জানালা, প্রধান ফটক ইত্যাদি বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েন, তেমনি দেবতাগণও রাত্রে অর্থাৎ দক্ষিণায়ণে সবকিছু বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েন। এসময় বাহির থেকে প্রবেশ করার সুযোগ নেই, অর্থাৎ দক্ষিণায়ণে দেবলোক পুরোপুরি বন্ধ থাকে। আবার দেবগণের রাত পৌষ সংক্রান্তির দিন শেষ হয় বলে পরবর্তী উদয়ের ব্রহ্মমুহূর্ত থেকে (গোস্বামী মতে) দেবগণের দিবা শুরু হয়। উক্ত সময়ে স্বর্গবাসী ও দেবলোকের সকলেই নিদ্রা ভঙ্গ হয় এবং নিত্য ভগবৎ সেবা মূলক ক্রিয়াদি শুরু হতে থাকে। এই জন্য সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ ব্রহ্মমুহূর্তে স্নান, নামযজ্ঞ, গীতাপাঠ, শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনি ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটিকে আনন্দময় করে তোলেন। স্মৃতিচিন্তামণি গ্রন্থে বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে- “দিনসংক্রমণে কৃৎস্নং দিনং পুণ্যম। অর্থাৎ সংক্রান্তি দিনের বেলা সংক্রমণ ঘটলে সমস্তদিনই পুণ্যকাল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোন ব্রত বা উপবাস করার পূর্বে যেরকম সংযম করে ব্রতাদি পালন করা হয় এবং কীর্তন শুরুর পূর্বে যেমন অধিবাস অনুষ্ঠিত হয় তেমনি উত্তরায়ণকে সামনে রেখে পূর্ববর্তী তিথিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ পূজা-পার্বণ এবং নামযজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করে থাকেন। উত্তরায়ণে দেবতাগণ জাগ্রত হওয়ার শুভলগ্নে পুজা-পার্বণের দ্বারা তাঁদের সন্তুষ্টির ক্রমে যাতে দেবধামে পৌছে পরবর্তীতে সেখান থেকে দেবগণের সহায়তায় ভগবৎধামে যাওয়ার সুর্কীতিটুকু অর্জন করা যায়; এই উদ্দেশ্যে দেবতাদের পূজা-পার্বণ করে তাঁদের অশেষ কৃপা লাভ করা। মানুষ যা করতে পারে না দেবগণ তা অতি সহজে করতে পারেন। তাই উত্তরায়ণ পদার্পণের শুভক্ষণে এবং দেবগণ জাগ্রত হওয়ার পূণ্যলগ্ন ব্রহ্মমুহূর্তে স্নানসমাপন পূর্বক আহ্নিক ক্রিয়াদি শেষে ফুল-তুলসি, সাধ্যমত প্রসাদি নিবেদন পূর্বক যজ্ঞ, পূজা, প্রার্থনা, অতিথিসেবা ইত্যাদির মাধ্যমে ভগবৎধামে যাওয়ার সুর্কীতিটুকু অর্জন করার চেষ্টা করা হয়। কারণ জীবের প্রকৃত ঠিকানা ভগবৎধাম। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন-‘যদ্গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম’ (১৫/৬)। অর্থাৎ যাকে প্রাপ্ত হলে জীব আর সংসারে ফিরে আসে না, সেটাই আমার পরম ধাম। একথায় ইহাই বুঝানো হয়েছে যে, পরমাত্মার ধাম জীবের নিজের মূল ঠিকানা বলে আর ফিরতে হয় না। মানুষ যেমন নিজ বাড়ীতে গেলে অন্য বাড়ীতে থাকার প্রয়োজন হয় না তেমনি জীব পরমাত্মার ধামে গেলে আর ফিরত হয় না। ভগবান আরও বলেছেন-‘মামুপেত্য তু কৌন্তেয় পুনর্জম্ম ন বিদ্যতে’ (৮/১৬) অর্থাৎ হে কুন্তীপত্রÑ আমাকে প্রাপ্ত হলে আর পুনর্জন্ম হয় না। কারণ জীব পরমাত্মারই অংশ (১৫/৭)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ